আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রচনা ৫০০ শব্দের
ভূমিকা
ভাষা হলো মানুষের মনের ভাব প্রকাশের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। মাতৃভাষায় আমরা সহজেই মনের কথা বলতে পারি, যা অন্য কোনো ভাষায় সম্ভব নয়। এই কারণেই ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলার সাহসী ছেলেরা মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার জন্য নিজেদের রক্ত দিয়েছিল। তাদের এই আত্মত্যাগের কারণে দিনটি বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি গৌরবময় অধ্যায় হয়ে আছে। ভাষার জন্য এমন আত্মত্যাগ বিশ্ব ইতিহাসে খুব কমই দেখা যায়। এই দিনটির গুরুত্ব বিশ্বনেতাদেরও মনে দাগ কেটেছিল। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর থেকে প্রতিবছর এই দিনটি সারা বিশ্বে মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে।
মাতৃভাষা
মাতৃভাষা মানে মায়ের ভাষা। মানুষ জন্মের পর মায়ের কাছ থেকে প্রথম যে ভাষা শেখে, সেটাই তার মাতৃভাষা। সহজ কথায়, জন্মের পর শিশু তার মায়ের কাছ থেকে যে ভাষা শেখে, তাকেই মাতৃভাষা বলে। এটি একটি জাতির নিজস্ব ভাষা। মাতৃভাষার মাধ্যমেই প্রতিটি জাতি বা গোষ্ঠী তাদের ভাবনা ও অনুভূতি প্রকাশ করে।
মাতৃভাষা দিবসের পটভূমি
বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ সালে। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার বিরুদ্ধে বাঙালিরা তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয়। পাকিস্তান সরকার আন্দোলন দমন করতে ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ছাত্ররা এই নির্দেশ অমান্য করে মিছিল বের করলে পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়। গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকেই শহিদ হন। তাদের রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পায়। এই দিনটি বাঙালির ইতিহাসে একটি গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ভাষা আন্দোলনের চেতনা
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির চেতনায় জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করে। এই চেতনা ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে আরও শক্তিশালী হয়। এই আন্দোলনের ফলে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতন ঘটে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভাষা আন্দোলনের চেতনা বাঙালিকে অনুপ্রেরণা দেয়। ১৯৫২ সালে বাঙালি বুঝতে পেরেছিল যে পাকিস্তানিরা তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি কেড়ে নিতে চাইছে। এই উপলব্ধি থেকেই বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরু করে। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাঙালি বিজয় অর্জন করে। এই বিজয়ের পেছনে ভাষা আন্দোলনের চেতনা কাজ করেছিল।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে একুশ
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর থেকে প্রতিবছর সারা বিশ্বে এই দিনটি পালিত হয়ে আসছে। ইউনেস্কোর এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাংলা ভাষা বিশ্বে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ ভাষা শহিদদের আত্মত্যাগ বিশ্ব ইতিহাসে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের উদ্যোক্তা
একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পেছনে কানাডার ‘মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্যা ওয়ার্ল্ড’ নামের একটি সংগঠনের ভূমিকা রয়েছে। এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দুজন বাঙালি যুবক রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম। তারা প্রথমে জাতিসংঘের কাছে আবেদন জানান। পরে বাংলাদেশ সরকার ইউনেস্কোতে প্রস্তাব উত্থাপন করে। ১৯৯৯ সালের ১৬ নভেম্বর ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।
উপসংহার
বাংলা ভাষা এখন শুধু বাংলাদেশের সীমানায় সীমাবদ্ধ নেই। এটি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। ২১শে ফেব্রুয়ারি এখন শুধু বাঙালির নয়, সারা বিশ্বের মানুষের মাতৃভাষা দিবস। এই দিনটি ভাষার মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায় বিশ্ববাসীকে একত্রিত করে। ভাষার চেতনা ও সংস্কৃতির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে এই দিনটি একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করে।