মধুর ক্যান্টিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস এবং বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে একটি পরিচিত নাম। এটি শুধু একটি ক্যান্টিন নয়, বরং এটি একটি ঐতিহাসিক স্থান। বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্মস্থান হিসেবে এই ক্যান্টিনের গুরুত্ব অপরিসীম। এখানে এসে ছাত্ররা শুধু খাবার খায়নি, তারা দেশের জন্য স্বপ্ন দেখেছে, আন্দোলন করেছে।
ইতিহাসের সাক্ষী মধুর ক্যান্টিন
মধুর ক্যান্টিনের প্রতিষ্ঠাতা মধুসূদন দে (মধু) ছিলেন একজন সাধারণ সনাতনী মানুষ। কিন্তু তার অবদান অসাধারণ। তিনি শুধু ক্যান্টিন চালাতেন না, ছাত্রদের সাথে মিশে তাদের সমস্যা শুনতেন। তিনি ছিলেন ছাত্রদের বন্ধু। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালায়। এই হামলার সময় মধুসূদন দেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় জগন্নাথ হলে। সেখানে তাকে হত্যা করা হয়। তার সাথে অনেক ছাত্রও শহীদ হন।
মুক্তিযুদ্ধের পর মধুসূদন দে এর ছেলে অরুণ কুমার দে ক্যান্টিনের দায়িত্ব নেন। তিনি বাবার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। আজও মধুর ক্যান্টিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য একটি প্রিয় জায়গা। এটি শুধু খাবারের জায়গা নয়, এটি একটি মিলনস্থল।
মধুর ক্যান্টিনের বর্তমান অবস্থানটি স্থাপত্য ও ঐতিহ্যের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো ইতিহাসের সাক্ষী। এই ক্যান্টিনের দেয়ালে লেগে আছে অসংখ্য স্মৃতি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের গুরুত্ব
বিষয় | বিবরণ |
---|---|
স্থান | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় |
প্রতিষ্ঠাতা | মধুসূদন দে |
স্থাপত্য মূল্য | ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক |
রাজনৈতিক ভূমিকা | ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্র |
মধুর ক্যান্টিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ঐতিহাসিক স্থান। এটি শুধু একটি ক্যান্টিন নয়, বরং বাংলাদেশের ইতিহাসের সাক্ষী। ১৯২১ সালে মধুসূদন দে (মধু) এই ক্যান্টিন প্রতিষ্ঠা করেন। তার বাবা আদিত্য চন্দ্রের সহযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খাবারের দোকান শুরু হয়। তখন বিশ্ববিদ্যালয়টি ছিল বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ ভবনে। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস ফ্যাকাল্টি নিলক্ষেতে স্থানান্তরিত হলে মধুর ক্যান্টিনও সেখানে চলে আসে।
মধুর ক্যান্টিনের ঐতিহাসিক ভূমিকা
মধুর ক্যান্টিন শুধু খাবারের জায়গা নয়, এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলন, ছাত্রদের কালা কানুন বিরোধী আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে মধুর ক্যান্টিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই ক্যান্টিনে ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক কর্মীরা নিয়মিত মিলিত হতেন। তারা এখানে আলোচনা করতেন এবং পরিকল্পনা করতেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে। এই সময় তারা মধুর ক্যান্টিনকে লক্ষ্যবস্তু করে। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে মধুসূদন দে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হন। সেনাবাহিনী তার বাড়িতে হামলা চালায়। ভোররাতে তারা গুলি চালায়। মধুসূদন দে, তার স্ত্রী, ছেলে এবং বউমা সেদিন নিহত হন। মধুসূদন দে আহত অবস্থায় ধরা পড়েন। তাকে জগন্নাথ হলের মাঠে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। সেদিন অনেক ছাত্রও প্রাণ হারায়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মধুর ক্যান্টিন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধের পর এটি পুনর্নির্মাণ করা হয়। ক্যান্টিনটি তার মূল স্থান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। বর্তমানে এটি ঢাকা নবাবদের দরবার হলের পুরনো ভবনে অবস্থিত। এই ভবনটি ১৮৭৩ সালে নির্মাণ শুরু হয়। এটি কয়েক বছর ধরে তৈরি হয়। ১৯০৬ সালে নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহ এই ভবনে একটি সম্মেলনের আয়োজন করেন। এই সম্মেলনে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
মধুর ক্যান্টিনের সামনে ১৯৯৫ সালে মধুসূদন দের একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়। এই মূর্তিটি তৈরি করেন চারুকলার ছাত্র তৌফিক হোসেন খান। মূর্তিটি ক্যান্টিনের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
মধুর ক্যান্টিন শুধু একটি ক্যান্টিন নয়, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অংশ। এটি ছাত্র, শিক্ষক ও রাজনৈতিক কর্মীদের মিলনস্থল ছিল। এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাক্ষী।
মধুর ক্যান্টিনের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী
সাল | ঘটনা |
---|---|
১৯২১ | মধুর ক্যান্টিন প্রতিষ্ঠা |
১৯৪৮ | ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা |
১৯৫২ | ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা |
১৯৪৯ | চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলন |
১৯৬৯ | গণঅভ্যুত্থান |
১৯৭১ | পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হামলা |
১৯৯৫ | মধুসূদন দের মূর্তি স্থাপন |
বর্তমানে মধুর ক্যান্টিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য একটি জনপ্রিয় জায়গা। এখানে এখনও ছাত্ররা আড্ডা দেন, আলোচনা করেন। ক্যান্টিনটি তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এটি শুধু খাবারের জায়গা নয়, এটি ইতিহাসের একটি জীবন্ত অংশ।
শেষ কথা
মধুর ক্যান্টিন বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি শুধু একটি ক্যান্টিন নয়, এটি একটি স্মৃতিস্তম্ভ। এখানে অনেক সংগ্রাম, ত্যাগ ও বিজয়ের গল্প জড়িয়ে আছে। মধুসূদন দে ও তার পরিবারের আত্মত্যাগ এই ক্যান্টিনকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। মধুর ক্যান্টিন আমাদের ইতিহাসের একটি গর্বিত অধ্যায়। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের সংগ্রাম ও বিজয়ের কথা। মধুর ক্যান্টিন শুধু একটি ক্যান্টিন নয়, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি জীবন্ত সাক্ষী।