আমরা যখন প্রযুক্তির দুনিয়ায় পা দিচ্ছি, তখন একটা প্রশ্ন বারবার মাথায় আসে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই (Artificial Intelligence) কি আমাদের জীবনের সবকিছু বদলে দেবে? বিশেষ করে শিক্ষকতার মতো পেশা, যেটা আমরা মানুষের হাতেই দেখতে অভ্যস্ত, সেটাও কি এআই-এর হাতে চলে যাবে?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের চোখ পড়ে বিশ্বের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব বিল গেটসের দিকে। তিনি এআই নিয়ে যেমন আশাবাদী, তেমনি কিছু উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন। আজকের এই লেখায় আমরা বিল গেটসের চিন্তাভাবনা আর তার ভবিষ্যৎ ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে আলোচনা করবো।
Ai শিক্ষকতা পেশাকে গ্রাস করবে
বিল গেটস মনে করেন, এআই মানুষের জন্য অনেক ভালো কিছু করতে পারে। তিনি বলেন, এই প্রযুক্তি প্রাণঘাতী রোগের চিকিৎসায়, জলবায়ু পরিবর্তনের সমাধানে এবং সবার জন্য ভালো শিক্ষার ব্যবস্থা করতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কল্পনা করুন, এমন একটা দুনিয়া যেখানে এআই-এর সাহায্যে ডাক্তাররা দ্রুত রোগ ধরতে পারছেন, বা শিক্ষার্থীরা বাড়িতে বসেই বিশ্বমানের পড়াশোনা করতে পারছেন। গেটসের এই কথাগুলো শুনলে মনে হয়, এআই সত্যিই আমাদের জীবনকে আরও সহজ আর উন্নত করতে পারে।
তবে তিনি এটাও বলেন যে, এআই সব কাজে পারফেক্ট নয়। এটি অনেক সময় ভুল করে এবং ভুল তথ্য ছড়াতেও পারে। এই দিকটা নিয়ে তিনি একটু চিন্তিত। কিন্তু তারপরও তিনি আশা ছাড়েন না। তিনি বলেন, “কিছু কাজ মানুষই করবে, কিন্তু উৎপাদন, পরিবহন আর কৃষিতে এআই অনেক বড় ভূমিকা পালন করবে।” তবে তিনি এটাও মানেন যে, ডাক্তারি আর শিক্ষকতার মতো পেশার একটা বড় অংশ এআই দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতে পারে। এই কথাটা শুনে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে—তাহলে কি শিক্ষকদের দিন শেষ হয়ে যাবে?
শিক্ষকতা এমন একটা পেশা, যেখানে শুধু জ্ঞান দেওয়া নয়, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কও জড়িত। একজন শিক্ষক শুধু বইয়ের পড়া শেখান না, তিনি ছাত্রদের মন বোঝেন, তাদের উৎসাহ দেন, জীবনের পথ দেখান। এআই কি এই কাজগুলো করতে পারবে? বিল গেটসের মতে, এআই শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক কিছু করতে পারে, যেমন—পড়াশোনার উপকরণ তৈরি করা, পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করা, এমনকি ছাত্রদের দুর্বলতা ধরে সেটা শুধরে দেওয়া। কিন্তু মানুষের মতো সহানুভূতি বা আবেগ বোঝার ক্ষমতা এখনও এআই-এর নেই।
তবে গেটসের কথা থেকে এটাও পরিষ্কার যে, এআই শিক্ষকদের পুরোপুরি সরিয়ে দেবে না, বরং তাদের কাজের ধরন বদলে দিতে পারে। ধরা যাক, এআই যদি পড়াশোনার মূল অংশটা সামলায়, তাহলে শিক্ষকরা হয়তো ছাত্রদের সঙ্গে আরও বেশি সময় কাটাতে পারবেন, তাদের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে সাহায্য করতে পারবেন। এটা একটা নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে পারে।
এআই দ্রুত উন্নতি বিল গেটসের বিস্ময়
বিল গেটস নিজেও এআই-এর এত দ্রুত উন্নতি দেখে অবাক হয়েছেন। তিনি একবার OpenAI-কে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন, এমন একটা মডেল বানাতে যেটা AP Biology পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি নম্বর পাবে। তিনি ভেবেছিলেন, এটা বানাতে কয়েক বছর লাগবে। কিন্তু OpenAI মাত্র কয়েক মাসেই এই কাজটা করে ফেলে! গেটস এটাকে প্রযুক্তির ইতিহাসে একটা বড় ধাপ বলে মনে করেন। তিনি বলেন, “১৯৮০ সালে গ্রাফিকাল ইউজার ইন্টারফেস (GUI) আবিষ্কারের পর এটাই সবচেয়ে বড় উদ্ভাবন।”
এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, এআই কতটা দ্রুত এগোচ্ছে। প্রায় এক দশক আগে গেটস ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, এআই বিশ্বকে বদলে দেবে। ২০১৭ সালে তিনি বলেছিলেন, এআই নিয়ে যে গবেষণা হচ্ছে, তা ভবিষ্যতে বিরাট পরিবর্তন আনবে। তিনি Google DeepMind-এর সাফল্যের কথাও উল্লেখ করেন, যেখানে একটা এআই প্রোগ্রাম ‘গো’ খেলায় মানুষকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। সেই সময় ChatGPT-এর মতো জেনারেটিভ এআই ছিল শুরুর দিকে। কিন্তু এখন দেখুন, এআই কতদূর চলে এসেছে!
গেটস মনে করেন, এআই একটা বিশাল সুযোগ। তিনি বলেন, যদি তিনি এখন নতুন কোনো ব্যবসা শুরু করতেন, তাহলে সেটা অবশ্যই এআই-কেন্দ্রিক হতো। তিনি তরুণদেরও এই খাতে কাজ করতে উৎসাহ দেন। তার কথায়, “এটাই ভবিষ্যতের পথ। তোমরা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে।” এই কথাগুলো শুনলে মনে হয়, এআই শুধু একটা প্রযুক্তি নয়, এটা একটা নতুন যুগের শুরু।
তবে এআই-এর এত উন্নতি দেখে আমাদের মনে একটা ভয়ও জাগে। যদি এআই শিক্ষকদের কাজ কেড়ে নেয়, তাহলে কী হবে? গেটসের মতে, এআই মানুষের জন্য নতুন কাজের সুযোগও তৈরি করবে। যেমন—এআই বানানো, এটাকে আরও ভালো করা, বা এটার সঙ্গে মিলে কাজ করার জন্য নতুন ধরনের পেশা তৈরি হতে পারে। তাই শিক্ষকদের পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার ভয়টা হয়তো এখনই করতে হবে না।
আমাদের কী করা উচিত
বিল গেটসের কথা থেকে আমরা একটা জিনিস পরিষ্কার বুঝতে পারি—এআই এখন আমাদের জীবনের একটা বড় অংশ হয়ে উঠছে। এটা থেকে পালিয়ে লাভ নেই, বরং এটাকে বুঝে, এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। শিক্ষকদের জন্য এটা মানে হতে পারে, নতুন প্রযুক্তি শেখা, এআই-এর সঙ্গে কীভাবে কাজ করা যায় সেটা বোঝা। ছাত্রদের জন্যও এটা একটা সুযোগ—তারা এআই ব্যবহার করে নিজেদের জ্ঞান আর দক্ষতা বাড়াতে পারে। আমরা যদি গেটসের কথা মন দিয়ে শুনি, তাহলে দেখবো, তিনি এআই নিয়ে শুধু স্বপ্নই দেখেন না, বাস্তবতার কথাও বলেন। তিনি জানেন, এআই-এর অনেক সম্ভাবনা আছে, কিন্তু এটার সীমাবদ্ধতাও আছে। তাই আমাদেরও এই দুই দিক মাথায় রেখে এগোতে হবে।
প্রযুক্তির এই যুগে আমরা সবাই একটা বড় পরিবর্তনের মুখোমুখি। বিল গেটসের মতো মানুষ যখন বলছেন যে, এআই আমাদের ভবিষ্যৎ, তখন আমাদেরও সেটা মেনে নিয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে। শিক্ষকতা পেশা হয়তো পুরোপুরি হারিয়ে যাবে না, কিন্তু এআই-এর ছোঁয়ায় এটার রূপ বদলে যেতে পারে। আমরা যদি এই পরিবর্তনকে ভয় না পেয়ে, বরং সুযোগ হিসেবে দেখি, তাহলে হয়তো একটা নতুন আর সুন্দর দুনিয়ার দিকে এগিয়ে যেতে পারবো। আপনি কী মনে করেন এআই কি সত্যিই শিক্ষকদের জায়গা নেবে, নাকি তাদের আরও শক্তিশালী করে তুলবে? এটা নিয়ে ভাবার সময় এখনই।