হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মানব ইতিহাসের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি ইসলামের শেষ নবী হিসেবে পৃথিবীর জন্য এক উজ্জ্বল আদর্শ রেখে গেছেন। মক্কার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। শৈশব থেকেই তিনি সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততার জন্য পরিচিত ছিলেন। ৪০ বছর বয়সে তিনি নবুয়ত লাভ করেন এবং ইসলামের বাণী প্রচার শুরু করেন। মক্কা ও মদিনায় তাঁর সংগ্রাম, মক্কা বিজয় এবং শেষ জীবন মানবজাতির জন্য গভীর শিক্ষা বহন করে। তাঁর ন্যায়পরায়ণতা, সহানুভূতি ও নেতৃত্বগুণ আজও বিশ্ববাসীর জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী রচনা
ভূমিকা
মানব ইতিহাসে এমন কিছু মহান ব্যক্তিত্ব আছেন, যাঁদের জীবন ও কর্ম সমগ্র বিশ্বের জন্য পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছে। তাঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। তিনি শুধু একজন ধর্মীয় নেতাই ছিলেন না, বরং মানবতার মুক্তিদাতা, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাতা এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ ব্যক্তিত্ব। তাঁর জীবনী শুধু মুসলমানদের জন্যই নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য শিক্ষণীয়। তিনি শান্তি, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও ন্যায়বিচারের অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তাঁর জীবন ও আদর্শ জানার মাধ্যমে আমরা সত্য ও নৈতিকতার পথ খুঁজে পেতে পারি।
প্রারম্ভিক জীবন
হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে আরবের মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল্লাহ এবং মাতার নাম আমিনা। জন্মের আগেই তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন এবং মাত্র ছয় বছর বয়সে তিনি মাতাকেও হারান। এরপর তাঁর দাদু আবদুল মুত্তালিব এবং পরে চাচা আবু তালিব তাঁকে লালন-পালন করেন। শৈশব থেকেই তিনি অন্যদের থেকে আলাদা ছিলেন। তাঁর চরিত্রে মিশ্রিত ছিল সততা, নম্রতা ও দয়া।
যৌবনকাল ও সততার পরিচয়
তরুণ বয়সেই তিনি সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও বিশ্বস্ততার জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠেন। মক্কাবাসীরা তাঁকে “আল-আমিন” (বিশ্বস্ত) এবং “আস-সাদিক” (সত্যবাদী) উপাধি দেন। তিনি ব্যবসায়িক কাজে যোগ দেন এবং খাদিজা (রাঃ) নামে এক ধনাঢ্য বিধবার ব্যবসা পরিচালনা করেন। খাদিজা (রাঃ) তাঁর সততা, চরিত্র ও দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল অত্যন্ত সুখী ও আদর্শ।
নবুয়তের সূচনা
৪০ বছর বয়সে, ৬১০ খ্রিস্টাব্দে, হেরা গুহায় ধ্যানরত অবস্থায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) প্রথম ওহি লাভ করেন। ফেরেশতা জিবরাইল (আঃ) তাঁর কাছে আল্লাহর বাণী নিয়ে আসেন – “ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাযি খালাক” (পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন)। এই ঘটনার মাধ্যমে তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী হিসেবে মনোনীত হন। এরপর তিনি মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদত ও ন্যায়ের পথে আহ্বান করতে শুরু করেন।
সংগ্রাম ও সাফল্য
নবুয়তের দায়িত্ব পাওয়ার পর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হন। মক্কার কাফেররা তাঁর বিরোধিতা শুরু করে এবং নানাভাবে তাঁকে কষ্ট দেয়। কিন্তু তিনি ধৈর্য ও দৃঢ়তার সাথে তাঁর মিশন চালিয়ে যান। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। মদিনায় তিনি একটি শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলেন। এরপর ধীরে ধীরে ইসলামের আলো সারা আরবে ছড়িয়ে পড়ে।
ইসলামের প্রচার ও মক্কার প্রতিকূলতা
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যখন আল্লাহর বাণী প্রচার করতে শুরু করেন, তখন প্রথমে তিনি গোপনে কাজ চালান। তিনি তাঁর কাছের আত্মীয়, বন্ধু এবং বিশ্বস্ত কিছু মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেন। এই সময়ে তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রাঃ), আবু বকর (রাঃ) এবং উমর (রাঃ) সহ অনেক সাহাবী ইসলাম গ্রহণ করেন। কিন্তু যখন তিনি ইসলামের বার্তা প্রকাশ্যে প্রচার করতে শুরু করেন, তখন মক্কার কুরাইশ নেতারা এবং ধর্মীয় গোষ্ঠী তাঁর বিরোধিতা শুরু করে। তারা মুসলিমদের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়, তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে বাধা দেয় এবং সামাজিকভাবে বয়কট করে। এমনকি অনেক মুসলিমকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। এই কঠিন সময়ে কিছু সাহাবি ধর্মীয় স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার জন্য আবিসিনিয়া (বর্তমান ইথিওপিয়া) দেশে হিজরত করেন। নবী (সাঃ) তাঁর চাচা আবু তালিবের সুরক্ষায় থেকে শান্তিপূর্ণভাবে ইসলামের প্রচার চালিয়ে যান, কিন্তু কুরাইশদের চাপ ক্রমেই বাড়তে থাকে।
মদিনায় হিজরত ও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা
৬২২ খ্রিস্টাব্দে, যখন মক্কায় মুসলিমদের ওপর অত্যাচার চরমে পৌঁছায়, তখন আল্লাহর নির্দেশে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মদিনায় হিজরত করেন। মদিনা তখন একটি বহু গোত্রের শহর ছিল, যেখানে স্থিতিশীল সমাজ ব্যবস্থা ছিল না। নবী (সাঃ) মদিনায় গিয়ে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই ঐক্যকে মদিনার সনদ বলা হয়, যা মুসলিম, ইহুদী এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি ও সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলে। মদিনার সনদে ধর্মীয় স্বাধীনতা, সাম্য এবং শান্তির মূলনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সনদ শুধু ইসলামের ইতিহাসেই নয়, বিশ্ব ইতিহাসেও একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে স্বীকৃত। মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সামাজিক, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক বিপ্লব সাধন করেন।
মক্কা বিজয় ও বিদায় হজ্জ
৬৩০ খ্রিস্টাব্দে, ৮ হিজরিতে, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর নির্দেশে মক্কা বিজয় করেন। কুরাইশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পর তিনি মক্কায় প্রবেশ করেন এবং সেখানকার মানুষদের সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। মক্কা বিজয়ের পর তিনি কুরাইশ নেতাদের ক্ষমা করে দেন এবং মক্কা থেকে মূর্তিপূজার প্রথা উৎখাত করেন। কাবা শরীফকে মুসলিমদের সর্বোচ্চ পবিত্র স্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১০ হিজরিতে (৬৩২ খ্রিস্টাব্দ) নবী করিম (সাঃ) শেষ বিদায় হজ্জ সম্পন্ন করেন। বিদায় হজ্জের ভাষণে তিনি মানবজাতির জন্য চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা দেন। তিনি সবাইকে ইহকাল ও পরকালে শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামের মূলনীতি অনুসরণ করার আহ্বান জানান।
ইন্তেকাল
৬৩ বছর বয়সে, ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুর পর ইসলামের প্রচার আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ইসলামের আলো পৌঁছায়।
উপসংহার
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) শুধু একজন ধর্মীয় নেতা নন, তিনি ছিলেন একজন মহান সংস্কারক, ন্যায়বিচারক এবং মানবতার আদর্শ। তাঁর জীবন ও শিক্ষা আজও সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য অনুসরণীয়। তিনি শান্তি, সাম্য এবং ন্যায়ের বার্তা দিয়ে গেছেন, যা আজও মানবজাতির জন্য পথনির্দেশক।