আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রচনা Class 5
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে এই রচনা যেকোনো শ্রেণির শিক্ষার্থীর জন্য উপযোগী। বিশেষ করে, সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সহজেই এটি বুঝতে পারবে। একইভাবে, দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্যও এটি প্রাসঙ্গিক। অর্থাৎ, সপ্তম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীর জন্য এই রচনা উপকারী হবে। মাতৃভাষার গুরুত্ব ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাস সম্পর্কে জানার জন্য এটি সহায়ক হবে। সবার জন্য উপযুক্ত ভাষায় লেখা এই রচনাটি পাঠ্য সহায়তা হিসেবে কাজে আসবে।
ভূমিকা
মাতৃভাষা হলো জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের এক অমূল্য সম্পদ। এটি মা ও মাটির মতোই প্রাকৃতিকভাবে আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। প্রতিটি মানুষ জন্মসূত্রে এই সম্পদের উত্তরাধিকারী হয়। মাতৃভাষা মানুষের পরিচয়ের প্রথম ও প্রধান ধাপ। মা ও মাটির প্রতি যেমন আমাদের গভীর ভালোবাসা থাকে, তেমনি মাতৃভাষার সাথেও আমাদের আত্মার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বাঙালির মাতৃভাষা বাংলা। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বাঙালি জাতি জীবন দিয়ে বিশ্ব ইতিহাসে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে। এই আত্মত্যাগের স্বীকৃতি হিসেবে শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে আমরা পেয়েছি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা। সারা বিশ্ব এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের পটভূমি
তৎকালীন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। অন্যদিকে উর্দু ছিল মাত্র সাত শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাকে উপেক্ষা করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। বাঙালিরা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং দাবি করে যে, সকল মাতৃভাষাই সমান মর্যাদার অধিকারী। তারা উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানায়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এই দাবি মানতে অস্বীকার করে। এর ফলে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে বাংলার ছাত্র-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। এই গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরও অনেকে শহিদ হন। এই ঘটনায় সারা বাংলায় আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত সরকার বাধ্য হয়ে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর থেকে প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস হিসেবে পালিত হয়। মাতৃভাষার জন্য এ ধরনের আত্মত্যাগের নজির বিশ্ব ইতিহাসে এই প্রথম। এই দিনটির বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার জন্য ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর সাধারণ অধিবেশনে সর্বসম্মতভাবে এক প্রস্তাব গৃহীত হয়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্বীকৃতির উদ্যোগ
১৯৯৮ সালে কানাডার প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠন ‘মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ অব দ্যা ওয়ার্ল্ড’ একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। এই উদ্যোগে বিশেষ ভূমিকা রাখেন সংগঠনটির দুজন ব্যক্তিত্ব আবদুস সালাম ও রফিকুল ইসলাম। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে এই বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপিত হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর ৩১তম সম্মেলনে ২৭টি দেশের সমর্থনে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশ এই দিনটি নিজ নিজ মাতৃভাষার সম্মানে শ্রদ্ধার সাথে পালন করে আসছে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য অপরিসীম। প্রথমত, এটি ছোট-বড় সকল ভাষার প্রতি সমান মর্যাদা প্রদর্শনের বার্তা দেয়। দ্বিতীয়ত, এটি শক্তিশালী ভাষার দ্বারা দুর্বল ভাষার ওপর প্রভুত্ব আরোপ না করার আহ্বান জানায়। তৃতীয়ত, এটি ভাষাকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার গুরুত্ব তুলে ধরে। চতুর্থত, এটি প্রতিটি ভাষাকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। পঞ্চমত, এটি সকল মাতৃভাষাকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেওয়ার কথা বলে। এর ফলে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ নিজ নিজ ভাষাকে গর্বের সাথে ধারণ করবে এবং অন্য ভাষার প্রতিও সম্মান দেখাবে।
উপসংহার
মহান ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ ৪৭ বছর পর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এটি মূলত ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে যারা মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন, তাদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি তখনই সার্থক হবে যখন আমরা জ্ঞানের সকল ক্ষেত্রে মাতৃভাষা বাংলার প্রয়োগ ঘটাবো। নিজ ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বের সকল ভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মধ্যেই নিহিত আছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সার্থকতা। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যমই নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয়েরও প্রতীক।