ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল একটি অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের লীলাভূমি। এই অঞ্চলের সাতটি রাজ্য অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম ও মেঘালয় একত্রে সেভেন সিস্টার্স (Seven Sisters) নামে পরিচিত। এই নামটি শুনলেই মনে হয় যেন একই পরিবারের সাত বোনের মতো, যারা একে অপরের সাথে গভীরভাবে জড়িত। আজ আমরা এই সাত বোন রাজ্যের ইতিহাস, বৈশিষ্ট্য এবং তাদের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করব।
সেভেন সিস্টার্স নামকরণের ইতিহাস
১৯৭২ সালে ত্রিপুরার সাংবাদিক জ্যোতিপ্রসাদ সাইকিয়া প্রথমবারের মতো এই সাত রাজ্যকে “সপ্তভগিনীর এলাকা” (Land of the Seven Sisters) নামে অভিহিত করেন। তিনি একটি বেতার অনুষ্ঠানে এই শব্দটি ব্যবহার করেন এবং পরবর্তীতে একটি বইয়ে এই রাজ্যগুলোর মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতা ও সাধারণত্বের উপর আলোকপাত করেন। তাঁর এই প্রচেষ্টার ফলে সেভেন সিস্টার্স নামটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
২০০৩ সালে সিকিমকে উত্তর-পূর্ব পরিষদের সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যদিও সিকিম ভৌগোলিকভাবে এই সাত রাজ্য থেকে আলাদা, তবুও সাংস্কৃতিক দিক থেকে এদের সাথে এর মিল রয়েছে। তবে সিকিমকে “ক্ষুদ্র ভ্রাতা” (Little Brother) বলা হয়, সেভেন সিস্টার্সের অষ্টম ভগিনী নয়।
সেভেন সিস্টার্স বলা হয় কোন অঞ্চলকে
এই সাত রাজ্য মিলে ২,৬২,১৮৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, যা ভারতের মোট ভূমির প্রায় ৪ শতাংশ। এই অঞ্চলের দক্ষিণ-পশ্চিমে বাংলাদেশের সাথে ১,৫৯৬ কিলোমিটার আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে।
রাজ্য | রাজধানী |
---|---|
আসাম | গুয়াহাটি |
মিজোরাম | আইজল |
অরুণাচল প্রদেশ | ইন্দিরাগিরি |
মেঘালয় | শিলং |
ত্রিপুরা | আগরতলা |
মণিপুর | ইম্ফল |
নাগাল্যান্ড | কোহিমা |
এই রাজ্যগুলোতে জাতিগত ও ধর্মীয় বৈচিত্র্য রয়েছে। যেমন, আসামে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী বসবাস করে। অন্যদিকে, নাগাল্যান্ড ও মিজোরামে খ্রিস্টান ধর্মের প্রাধান্য দেখা যায়। তবুও, এই রাজ্যগুলো রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে একে অপরের সাথে গভীরভাবে জড়িত।
এই সাত রাজ্যের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। ব্রিটিশ শাসনামলে এই অঞ্চলগুলি ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা ছিল। আসাম ছিল ব্রিটিশদের অধীনে, কিন্তু বাকি রাজ্যগুলো স্থানীয় আদিবাসী রাজাদের শাসনে ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর এই রাজ্যগুলো ধীরে ধীরে ভারতের সাথে যুক্ত হয়।
বর্তমানে এই অঞ্চলে কিছু আদিবাসী গোষ্ঠী তাদের স্বাধীনতার দাবি তুলেছে। যেমন, নাগাল্যান্ড ও মণিপুরে নাগা সম্প্রদায় তাদের স্বাধীন ভূমির দাবি জানিয়েছে। সম্প্রতি ভারতের স্বাধীনতা দিবসে মণিপুরে হাজারো মানুষ নাগা পতাকা উড়িয়ে তাদের সমর্থন প্রকাশ করেছে।
সেভেন সিস্টার্সের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব
এই সাত রাজ্য ভূরাজনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদের অবস্থান ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে, যা চীন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সাথে সংযুক্ত। এই অঞ্চলটি প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ, যেমন তেল, গ্যাস, কয়লা এবং বনজ সম্পদ।
তবে, এই রাজ্যগুলোতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অভাব রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার এই অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য বিশেষ প্রকল্প চালু করেছে, যেমন উত্তর-পূর্ব উন্নয়ন মন্ত্রক (Ministry of Development of North Eastern Region)।
সেভেন সিস্টার্স মনে রাখার কৌশল
এই সাত রাজ্যের নাম মনে রাখার একটি সহজ কৌশল হলো আমি অমেত্রি মনা:
- আ – আসাম
- মি – মিজোরাম
- অ – অরুণাচল প্রদেশ
- মে – মেঘালয়
- ত্রি – ত্রিপুরা
- ম – মণিপুর
- না – নাগাল্যান্ড
আরও পড়ুন– আধুনিক মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম।
FAQs প্রায়ই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন
১. সেভেন সিস্টার্স নামটি কে দিয়েছিলেন?
উত্তর: ত্রিপুরার সাংবাদিক জ্যোতিপ্রসাদ সাইকিয়া ১৯৭২ সালে এই নামটি দিয়েছিলেন।
২. সেভেন সিস্টার্সের মধ্যে কোন রাজ্যটি সবচেয়ে বড়?
উত্তর: আসাম সেভেন সিস্টার্সের মধ্যে সবচেয়ে বড় রাজ্য।
৩. সিকিম কি সেভেন সিস্টার্সের অংশ?
উত্তর: না, সিকিমকে “ক্ষুদ্র ভ্রাতা” বলা হয়।
৪. সেভেন সিস্টার্সের মোট আয়তন কত?
উত্তর: এই সাত রাজ্যের মোট আয়তন ২,৬২,১৮৪ বর্গকিলোমিটার।
৫. সেভেন সিস্টার্সের রাজ্যগুলোর মধ্যে কোনটি সবচেয়ে ছোট?
উত্তর: ত্রিপুরা সেভেন সিস্টার্সের মধ্যে সবচেয়ে ছোট রাজ্য।
সেভেন সিস্টার্স শুধু ভারতের মানচিত্রের একটি অংশ নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক সম্পদ। এই রাজ্যগুলোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি এবং ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব এদেরকে বিশ্বে অনন্য করে তুলেছে। এই অঞ্চলের উন্নয়ন ও সংরক্ষণ ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি, এই লেখাটি আপনাকে সেভেন সিস্টার্স সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা দিতে পেরেছে। বন্ধুরা, এই ধরনের সাধারণ জ্ঞান পেতে শিক্ষা নিউজের হোয়াটসয়াপ চ্যানেলটিকে ফলো করুন।